কুমিল্লার হাট বাজারগুলোতে ঘুরে দেখা যায়, এসব হাটে মানুষের শ্রম কেনাবেচা নিয়ে চলে দর-কষাকষি করে। দুপক্ষের মধ্যে কেনাবেচা তথা মজুরির ব্যাপারে দফা-রফা হবার পর শেষ হয় বিক্রি পর্ব। শ্রম বিক্রি করা এসব অভাবী মানুষগুলো অবস্থাসম্পন্ন জোতদার, মহাজন, অবস্থা সম্পন্ন কৃষকের সাথে পিছু পিছু তাদের বাড়ি যান। সাথে থাকে নিজের দৈনন্দিন ব্যবহারের কাপড়-চোপড়ের পুটলি, ধান কাটার কাস্তে, কাটা ধান বহনের উপযোগী বাঁশের লাঠি।
মানুষের শ্রম কেনাবেচা এ হাটে সুঠামদেহী কমবয়সী লোকের দাম বেশি, শারীরিকভাবে দুর্বল, রোগা আর বয়স্কদের দাম তুলনামূলকভাবে কম।
কুমিল্লা জেলার সদর দক্ষিণ উপজেলার পদুয়ার বাজার, চৌয়ারা বাজার, সূয়াগঞ্জ বাজার, বিজয়পুর বাজার, লালমাই বাজার, বুড়িচং উপজেলা নিমসার বাজার, চান্দিনা বাজারসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলার বাজারগুলোতে ধান কাটা মৌসুমে ও ধানের চারা রোপনের মৌসুমে মানুষের শ্রম কেনাবেচা হাট বসে। এ সকল বাজারের মধ্যে পদুয়ার বাজার, শুয়াগঞ্জ বাজার, চৌয়ারা বাজার, নিমসার বাজার, লালমাই বাজার, ইলিয়টগঞ্জ বাজার, দেবিদ্বার বাজার, মুরাদনগর বাজার, বাঘমারাসহ বিভিন্ন বাজারে মানুষের শ্রম কেনাবেচা জন্য বেশ পরিচিতি লাভ করেছে। ধান কাটা ও ধানের চারা রোপনের মৌসুমে প্রতিদিনই এ সকল বাজারে শ্রম বিক্রির জন্য ভিড় করে শত শত শ্রমজীবী মানুষ। পণ্যের মতো বিক্রি করে তাদের শ্রম।
ধানকাটা ও ধানের চারা রোপনের মৌসুমে এসব শ্রমজীবীদের চাহিদা বেড়ে যায়। এ সময়টায় মজুরী ও বাড়ে সমান তালে। ভরা মৌসুমে প্রতিজন কৃষি শ্রমিকের দৈনিক মজুরি নির্ধারিত হয় ছয়শ টাকা থেকে সাতশ টাকায়। মৌসুমের কাজ কমে আসলে মজুরি নেমে আসে চারশ থেকে পাঁচশ টাকায়। সাথে থাকে দু’বেলা খাবার ও থাকার জায়গার ব্যবস্থা।
স্থানীয়রা জানায়, বাজারে শ্রম বিক্রি হতে আসা এ সব শ্রমজীবী মানুষগুলো যে দিন নিজের শ্রম বিক্রি করতে পারেন না, সেদিন তাদের রাত কাটে বাজারের কাছাকাছি কোন মসজিদ, মাদরাসা কিংবা স্কুল ঘরের বারান্দায়। কখনো আধা পেটে বা কখনো উপোস করে রাত কেটে যায় তাদের। সকাল হতেই আবার শ্রম বিক্রির আশায় চলে ছোটাছুটি।
এ সকল হাট-বাজারে শ্রম বিক্রি করতে আসা অভাবী মানুষদের বেশিরভাগেরই বাড়ি রংপুর, গাইবান্ধা, নীল ফামারী, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর, নেত্রকোণা ও ঠাকুরগাঁওসহ দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে।
পদুয়ার বাজারে কথা হয় রংপুর জেলার গঙ্গাচড়া উপজেলার ময়রাবাড়ি গ্রামের আবদুল মান্নানের ছেলে রহিদুল (২২) এবং একই উপজেলার চিড়িয়াখাল গ্রামের মৃত আজিম উদ্দিনের ছেলে শমসের আলীর (২৫) সঙ্গে। নিজদের আর্থিক অবস্থা ভাল না হওয়ার কারণে তারা কাজের আশায় ছুটে এসেছে এ এলাকায়। তাদের অনেকেরই জমি-জমা যা ছিল তা নদীর ভাঙনে চলে গেছে।
বিজয়পুর বাজারে কথা হয় ময়মনসিংহ জেলার ধোবার উপজেলার কাউসার কান্দি গ্রামের শেখ কাশেম আলীর ছেলে শেখ রজ্জব আলী (৩৫) ও সুরুজ আলীর ছেলে রফিকের (৩০) সঙ্গে। এ এলাকায় তারা পাঁচদিন আগে এসেছে। গত কয়েকদিন লালমাই এলাকার এক গৃহস্থের ক্ষেতের ধান কেটেছে। তাদের নিয়োগদাতা ওই গৃহস্থ দিনে ও রাতে তিন বেলা খেতে দিয়েছে। রাতে শোওয়ার জন্য কাঁথা বালিশ দিয়েছে বলে তারা জানায়। তারা আরও জানায়, নিয়োগদাতা গৃহস্থ ভাল লোক হলে থাকা খাবারের অসুবিধা হয় না। আবার নিয়োগ দাতাদের অনেকেই কাজের মানুষকে মানুষই মনে করেন না।
চৌয়ারা বাজারে কথা হয় নীলফামারী জেলার ডোমার উপজেলার হরিণ ধরা গ্রামের আজগর আলীর ছেলে দেলোয়ার হোসেনের (৩০) সঙ্গে। কাজের জন্য এ এলাকায় তার আসার কারণ জানতে চাইলে সে জানায়, নিজ এলাকায় তাদের কোন জায়গাজমি নেই। এলাকায় কোন কাজ না থাকলে ছুটে আসেন কুমিল্লায়। কাজ পেয়ে গেলে বেশ কয়েকদিন থাকবেন এখানে। কাজ শেষে সোজা বাড়ি ফিরে যাবেন।
দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে কাজের খোঁজে ছুটে আসা অভাবী মানুষদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এসব এলাকায় শ্রম বিক্রি করে তারা যা আয় করবে তা বাড়ি নিয়ে পরিবারের ভরণ-পোষণ ও অন্যান্য কাজে লাগান। কৃষির ভরা মৌসুমে তাদের এলাকায় শ্রমিকের মজুরী খুব কম। তবুও মৌসুমে তারা তাদের এলাকায় কাজ করেন। এলাকায় করার মতো কোনো কাজ না থাকলেই তারা বেরিয়ে পড়েন কাজের সন্ধানে। আসেন কুমিল্লার বিভিন্ন এলাকায় ধান কাটা ধানের চারা রোপন ও অন্যান্য কাজ করে কিছু রোজগার করে বাড়ি ফিরে যান। এভাবেই কাজের মৌসুমে এদের অনেকেই ছুটে আসেন এ এলাকায় এ রোজগার মৌসুমে হলেও এটা তাদের পরিবারের জন্য কিছুটা হলেও আর্থিক স্বচ্ছলতা এনে দেয়।